রাসূলুল্লাহ (সা.) কে মনোনীত করা এবং তাঁকে সকল সৃষ্টিজগতের উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করা।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সকল সৃষ্টিজগতের উপর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা দান করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ প্রসঙ্গে বলেনঃ নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা আমাকে তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন-যেমনিভাবে ইবরাহীম (আ.) কে তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছিলেন। (সহীহ মুসলিম)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেনঃ নিশ্চয় তোমাদের এই সাথী আল্লাহর অন্তরঙ্গ বন্ধু। (সহীহ মুসলিম)।
আর নিঃসন্দেহে আল্লাহর অন্তরঙ্গ বন্ধু হবার মর্যাদায় উপনীত হতে পারা মানুষের জন্য সর্বোচ্চ সম্মান ও অন্তহীন প্রাপ্তি।
দুনিয়াতে যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী তেমনি আখিরাতে ও তাঁকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে, বরং তা আরও সুউচ্চ ও বেশি মর্যাদা সম্পন্ন। আর কেনইবা সেটি হবেনা?! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আমি কিয়ামতের দিনে আদম সন্তানদের নেতা হব এবং আমিই প্রথম ব্যক্তি যার কবর উন্মুক্ত করে দেয়া হবে এবং আমিই প্রথম সুপারিশকারী ও প্রথম সুপারিশ গৃহীত ব্যক্তি। (সহীহ মুসলিম)।
ইমাম নববী (রহ.) এই প্রসঙ্গে বলেনঃ আলেমরা বলেছেনঃ সহীহ মুসলিম এ বর্ণিত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস, “আমি আদম সন্তানদের নেতা” তা তিনি অহংকার বশতঃ বলেননি, যার বিশদ বিবরণ মুসলিম শরীফ ছাড়া অন্য হাদীসে এসেছে, যাতে আমিত্ব বা অহংবোধকে বর্জন করে তিনি বলেনঃ “কিয়ামতের দিন আমিই হব বনী আদমের সরদার। এবং (আমি সেটি) কোন গর্ব প্রকাশের জন্য বলছিনা”। (ইবন মাজাহ)। তবে তিনি তা বলেছেন দু'কারণেঃ এক- আল্লাহ তা‘আলার বাণীঃ এবং আপনার পালনকর্তার নেয়ামতের কথা প্রকাশ করুন। [সূরা আদ-দুহা, আয়াত: ১১] এর উপর আমল করার জন্য। দ্বিতীয়- এই কথাটা তাঁর উম্মতের নিকট পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য যাতে তারা তাঁকে চিনে, তাঁর মর্যাদা জেনে-বুঝে সে অনুযায়ী তাঁকে শ্রদ্ধা করতে পারে এবং তাঁকে অনুসরণ করতে পারে যেমনটি করতে আল্লাহ তা’আলা মু’মিনদেরকে আদেশ করেছেন।
এ হাদীসটি সকল সৃষ্টিজগতের উপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে; কেননা আহলে সুন্নাহর মত হলো মানুষ ফেরেশতার চেয়ে উত্তম, আর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষ ও অন্য সকল সৃষ্টিজগতের সর্বশ্রেষ্ঠ। (ইমাম নববীর মুসলিমের ব্যখ্যাগ্রন্থ)।
কারো কাছে যদি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই হাদিসঃ “কিয়ামতের দিন আমিই হব বনী আদমের সরদার, এতে কোন অহংকার নেই”।(ইবন মাজাহ) নিয়ে কোন অস্পষ্টতা বা সংশয় জাগে এবং সে মনে করে যে এ হাদিসে কোনভাবে অহংবোধের প্রকাশ রয়েছে তাহলে তা কীভাবে খণ্ডন করা হবে?
সব নবী-রাসূলদের উপর রাসূলুল্লাহ (সা.) এর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা
আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ এই রাসূলগণ আমি তাদের কাউকে একে অপরের উপর মর্যাদাবান করেছি। তাদের মধ্যে কেউ তো হলো তারা যার সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন,আর কারও মর্যাদা উচ্চতর করেছেন। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫৩]।
রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন সব নবী-রাসূলদের ইমাম
আল্লাহ তা‘আলা আম্বিয়াদের মধ্যে রাসূলগণকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং রাসূলদের মধ্যে যাঁরা দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, আর দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ উপাধিতে ভূষিত রাসূল হলেন পাঁচজনঃ মুহাম্মাদ, নূহ, ইবরাহীম, মুসা ও ঈসা আলাইহিমুস সালাম, তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হলো, তাঁরা মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকতে উচ্চ সাহসীকতার পরিচয় দিয়েছেন, আল্লাহর পথে প্রচণ্ড কষ্ট সহ্য করেছেন, বাতিলের মোকাবিলায় তাঁরা দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ ছিলেন, ন্যায় ও হকের উপর তাঁরা শক্ত অবস্থানে ছিলেন। এ পাঁচজন দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ রাসূলদের মধ্যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে, তিনিই সর্বশেষ নবী ও সব নবী-রাসূলদের ইমাম।
এর প্রমাণ হলো ইসরা ও মি‘রাজের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যখন মক্কার মাসজিদুল হারাম থেকে বোরাক্বের সাহায্যে বায়তুল মাকদিস নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে নেমে তিনি সব আম্বিয়াদের ইমাম হয়ে নামায আদায় করেছিলেন। (যাদুল মা'আদ)।
সকল নবী-রাসূলদের উপস্থিতিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে ইমামতি করা প্রমাণ করে যে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, কেনই বা তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ হবেন না! তিনিই তো সর্বশেষ নবী, তাঁর রিসালাত সর্বশেষ আসমানি রিসালাত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার একটি দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন, তিনি বলেনঃ আমি এবং আমার পূর্ববর্তী নবীগণের অবস্থা এরূপ, এক ব্যাক্তি যেন একটি ভবন নির্মাণ করল; ইহাকে সুশোভিত ও সুসজ্জিত করল, কিন্তু এক কোনায় একটি ইটের জায়গা খালি রয়ে গেল। অতঃপর লোকজন ইহার চারপাশে ঘুরে বিস্ময়ের সহিত বলতে লাগল ঐ শূন্যস্থানের ইটটি লাগানো হল না কেন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমিই সেই ইট। আর আমিই সর্বশেষ নবী। (বুখারী ও মুসলিম)।
মুহাম্মাদ (সা.) এর প্রতি ঈমান এবং তাঁর সাহায্যের ব্যাপারে নবীগণের অঙ্গীকার
আল্লাহ তা’আলা সব নবী-রাসূলদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, তিনি যদি তাদের মাঝে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে প্রেরণ করেন তাহলে তাঁরা তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ আর আল্লাহ যখন নবীগনের কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহন করলেন যে, আমি যা কিছু তোমাদের দান করেছি কিতাব ও জ্ঞান এবং অতঃপর তোমাদের নিকট কোন রাসূল আসেন তোমাদের কিতাবকে সত্য বলে দেয়ার জন্য, তখন সে রাসূলের প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁর সাহায্য করবে। তিনি বললেন, ‘তোমরা কি অঙ্গীকার করছো এবং এই শর্তে আমার ওয়াদা গ্রহণ করে নিয়েছ? তাঁরা বললো, ‘আমরা অঙ্গীকার করেছি’। তিনি বললেন, তাহলে এবার সাক্ষী থাক। আর আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী রইলাম। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৮১]।
আলী ইবনে আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে এর পর যত নবী-রাসূল আসছে তাঁদের সকলের কাছ থেকে আল্লাহ তা‘আলা অঙ্গীকার গ্রহন করেছেন যে, তাঁদের জীবদ্দশায় যদি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করা হয় তাহলে তাঁরা তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে এবং তাঁরা তাঁদের জাতির কাছ থেকে ও এরূপ অঙ্গীকার গ্রহন করবে। (কিতাবুশ শিফা বি তা’রিফি হুকুকিল মুস্তফা।)।
আরও যে বিষয়গুলোতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অন্যান্য নবী-রাসূলদের উপর বিশিষ্টতা দান করা হয়েছে তা হলোঃ আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমাকে ছয়টি জিনিস দ্বারা অন্য নবীদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে, ১. আমাকে ব্যাপক তথ্যপূর্ণ ও অর্থবহ বাণী দান করা হয়েছে, ২. আমাকে প্রবল প্রভাব দ্বারা সাহায্য করা হয়েছে, ৩. আমার জন্য গনিমতের মাল হালাল করা হয়েছে, ৪. আমার জন্য মাটিকে পবিত্রকারী ও মসজিদ বানানো হয়েছে, ৫. আমাকে সমগ্র সৃষ্টিজগতের প্রতি প্রেরণ করা হয়েছে, ৬. আমার দ্বারা নবীদের সীল মোহর (নবুওয়াতের সমাপ্তি) করা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের আলোকে তাঁর নিম্নোক্ত হাদীসটিকে কীভাবে দেখছেন?
তিনি বলেনঃ খ্রিষ্টানরা মারইয়াম-এর পুত্র ‘ঈসা (আ.)-এর প্রশংসায় যেভাবে বাড়াবাড়ি করেছে, তোমরা সেভাবে আমার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করো না। আমি তো আল্লাহর বান্দা। তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা এবং আল্লাহর রাসূল বলো। (সহীহ বুখারী)।