ফরয রোযা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানে রোযা রেখেছেন এবং রোযা রাখার হুকুম দিয়েছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৩]। আল্লাহ তা‘আলা তাকওয়া এবং তাঁর নৈকট্য লাভের জন্য রোযা রাখতে বলেছেন। বস্তুত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাঁদ দেখা ব্যতীত বা চাঁদ দেখা প্রসঙ্গে সাক্ষীর সাক্ষ্য ব্যতীত রমজানের রোযা শুরু করতেন না, চাঁদ দেখা না গেলে বা সাক্ষ্য পাওয়া না গেলে শাবান মাস ত্রিশদিন পূর্ণ করতেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইফতার দেরি করতেন না বরং ওয়াক্ত হওয়ামাত্র ইফতার করার উপর তাগিদ দিতেন, তিনি বলেনঃ আমার উম্মাত যতদিন যাবৎ ওয়াক্ত হওয়ামাত্র ইফতার এর ইহতিমাম করবে, ততদিন তারা কল্যাণের উপর থাকবে। (বুখারী ও মুসলিম)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহরী করতেন এবং সাহরী করার জন্য তাগিদ দিতেন, তিনি বলেনঃ তোমরা সাহরী (এর সময়ে খাবার গ্রহণ) করো, কেননা সাহরীতে বরকত রয়েছে। (বুখারী ও মুসলিম)। তিনি সাহরী দেরি করে করতেন এবং দেরি করে করার জন্য তাগিদ দিতেন, তিনি বলেনঃ আমার উম্মাত যতদিন যাবৎ সাহরীতে বিলম্ব করবে এবং ওয়াক্ত হওয়ামাত্র ইফতার করবে ততদিন তারা কল্যাণের উপর থাকবে। (মুসনাদে আহমাদ)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায পড়ার আগে ইফতার করতেন, তাঁর ইফতার ছিলো কিছু পাকা খেজুর যদি পাওয়া যেতো, আর তা না পেলে শুকনো কয়েকটি খেজুরযোগে ইফতার করতেন। যদি শুকনো খেজুরও না হত, তাহলে কয়েক ঢোক পানি পান করতেন।’ (যাদুল মাআদ)।
নফল রোযা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাস ছাড়া অন্য সময় নফল রোযা রাখতেন, রোযার ব্যাপারে তাঁর দিকনির্দেশনা ছিলো মানুষের জন্য পরিপূর্ণ, উদ্দেশ্য সাধনে সবচেয়ে বেশী সহায়ক এবং একেবারে সহজ-সরল অনাড়ম্বর পদ্ধতি। তিনি কখনো কখনো নফল সিয়াম পালন করতেন, আবার মাঝে মাঝে তিনি পানাহার ও (সিয়াম পালন না করে) করতেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সিয়াম সম্বন্ধে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেনঃ তিনি একাধারে সিয়াম পালন করে যেতেন যাতে আমরা বলাবলি করতাম, তিনি অনেক সিয়াম পালন করেছেন, আর কখনো তিনি একাধারে পানাহার (সিয়াম পালন না করে) কাটিয়ে দিতেন, যাতে আমরা বলাবলি করতাম, তিনি অনেক দিন যাবৎ সিয়াম পালন করেননি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আসার পর রমযান মাস ছাড়া কখনো পূর্ণ এক মাস সিয়াম পালন করেননি। (সহীহ মুসলিম)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইফতার করতেন, তখন এই দো‘আ বলতেন, “যাহাবায যামা’উ, ওয়াবতাল্লাতিল উরুক্বু, ওয়া সাবাতাল আজরু ইন শা-আল্লাহু তা’আলা।” অর্থাৎ পিপাসা দূরীভূত হল, শিরা-উপশিরা সতেজ হল এবং আল্লাহর ফযলে সাওয়াব প্রাপ্য হলো ইনশাআল্লাহ। (আবূ দাউদ)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে ও সফরে কোথাও আইয়ামুল বিয এর (প্রতি চান্দ্র মাসের তেরো, চৌদ্দ ও পনের তারিখ) সিয়াম ছাড়তেন না। (সুনানে নাসাঈ)। তিনি আইয়ামুল বিয এর রোযা রাখার প্রতি উৎসাহ ও তাগিদ দিতেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতের জন্য শাওয়াল মাসের ছয় রোজার ফজিলত বর্ণনা করেছেন, এবং এমন পদ্ধতিতে তাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছেন যাতে তারা ছয় রোজা রাখার প্রতি উৎসাহিত হয়। তিনি বলেনঃ যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখল, অতঃপর শাওয়াল মাসে ছয়দিন রোজা রাখল সে যেন সারা বছর রোজা রাখল। (সহীহ মুসলিম)।
ছয় রোজা সারা বছর রোজা রাখার সমান কীভাবে হয়? এর উত্তর হলো, আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক সৎ কাজের বিনিময় দশ গুন দেন, তাহলে রমজানে এক মাস রোযা রাখাতে দশ মাসের সমান হলো, আর ছয়দিন রোজার দশ গুন হবে দুই মাস, মোট বার মাস, সুতরাং কেউ রমজান মাস রোযা রাখার পর শাওয়াল মাসের ছয় রোজা রাখলে সারা বছর রোযা রাখার সমান হলো।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পূর্বাপর সকল ভুল-ত্রুটি ও গুনাহসমূহকে আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক ক্ষমা করে দেওয়ার পরও তাঁর এভাবে রোযা রাখা ও এর প্রতি এতো গুরুত্বারোপ কিসের ইঙ্গিতবাহী?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন, এ দু’দিনে রোযা রাখার ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেনঃ সোমবার ও বৃহস্পতিবার আল্লাহ তা‘আলার কাছে আমল উপস্থাপন করা হয়, অতএব আমি পছন্দ করি যে,আমার আমল এ অবস্থায় উপস্থাপন করা হোক যে আমি রোযাদার। (মুসনাদে আহমাদ)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি মাসে তিনটি করে রোযা রাখতেন, আর তিনি আশুরার দিন রোযা রাখতেন। (আবূ দাউদ)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শা’বান মাসে বেশি রোযা রাখতেন, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেনঃ আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শা’বান মাসের চেয়ে কোন মাসে বেশী (নফল) সাওম পালন করতে দেখিনি। (সহীহ বুখারী)।
আমরা কীভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর এই আমলে কে অনুসরণ করব?
১- তাকওয়া এবং আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের জন্য রোযা রাখুন, মিথ্যা বলা ও মিথ্যা কেন্দ্রিক কাজ বর্জন করুন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তাঁর এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। (সহীহ বুখারী)।
২- সোমবার ও বৃহস্পতিবার নিয়মিত রোযা রাখুন, এই দুই দিনে আল্লাহ তা‘আলার কাছে বান্দার আমল উপস্থাপন করা হয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দু’দিনে নিয়মিত রোযা রাখতেন।
৩- আইয়ামুল বিয এর তিন দিন (প্রতি চান্দ্র মাসের তেরো, চৌদ্দ ও পনের তারিখ) রোযা রাখুন, এর ফযীলত অনেক দীর্ঘকাল রোযা রাখার সমান। সুতরাং এ দিনগুলোতে রোযা রাখার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুকরণে সচেষ্ট হোন।
৪- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশ মতে ওয়াক্ত হওয়া মাত্র দ্রুত ইফতার করুন এবং সাহরীর সময়ে খাবার বিলম্বে গ্রহণ করুন।
৫- সম্ভব হলে কিছু পাকা খেজুর দিয়ে ইফতার করুন, যেমনটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করতেন।
৬- শাওয়াল মাসের ছয় রোজা রাখার জন্য আন্তরিক ভাবে চেষ্টা করুন যেমনটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করতেন, তিনি নিয়মিত এই ছয় রোজা রাখতেন।